নির্মল বাতাসের সন্ধানেই সেদিন দুজনে গিয়েছিলাম পার্কে। পার্কে ঢুকতে না ঢুকতেই বন্ধুর সেলফোনটা বেজে উঠল বেরসিকের মতো। প্রকৃতির এই রসিকতায় বন্ধু স্পষ্টতই বিরক্ত হলো। কিন্তু পকেট থেকে ফোনটা বের করে কলটা রিসিভ করেই তার মুখ হাসিহাসি হয়ে গেল এবং সে অনবরত বলতে লাগল, জ্বি ভাই। জ্বি ভাই। জ্বি ভাই।
তা দেখেই যা বোঝার বুঝে নিলাম আমি, বন্ধুর অনেক অনেক বড় ভাইদের কোনো একজনের তাঁকে হঠাৎ দরকার পড়েছে। আর এই ভাইদের কথা সে কখনোই ফেলতে পারেনা। কিংবা ফেলতে চাইনা। মানে দাঁড়াচ্ছে, বন্ধু এখন আমাকে পার্কে একা ফেলে চলে যাবে তার কোনো এক বড় ভাইয়ের কাজে।
আমি বন্ধুর আশেপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। বন্ধু ফোনের লাইন কেটে অকৃত্রিম করুণ চোখে তাকাল আমার দিকে। বলল, যেতে হবে রে।
বন্ধুর করুণ চোখ আর মুখভঙ্গি দেখে হেসে ফেললাম আমি। বললাম, তা আর বলতে? যা তুই। বড়ভাই বলে কথা।
কোন ভাই ফোন করলেন বা ভাইয়ের কী দরকার তা আর জানতে চাইলাম না আমি। বন্ধু নিজে থেকেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল।
আমি তাড়াতাড়ি হাত তুলে বন্ধুকে থামিয়ে দিলাম। বললাম, থাক, থাক।
বন্ধু তখন চওড়া একটা হাসি দিয়ে বিদায় নিল। আর আমি ‘মানুষ মূলত একা‘ এই সুগভীর তত্ত্ব স্মরণ করে নিজেকে প্রবোধ দিলাম।
বন্ধু থাকলে হাঁটাহাঁটি করতাম। তখন আর ইচ্ছে করল না। কাছেই একটা বেঞ্চ খালি পেয়ে তাতেই বসে পড়লাম। বসে রইলাম প্রকৃতির দেয়া একাকিত্বকে বরণ করে নিয়ে।
একটু পরে প্রকৃতি ও মানুষের সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। সৌন্দর্য উপভোগের ফাঁকে একা মানুষের মনস্তত্বের কিছু জটিল বিশ্লেষণ মাথায় উঁকি দিতে লাগল। মানুষ মূলত একা হলেও প্রকৃতি বোধহয় একাকিত্ব পছন্দ করে না। প্রকৃতি আমাকে বেশিক্ষণ একা থাকতে দিল না। আমাকে সঙ্গ দেবার জন্যে প্রকৃতির একজন ছোট্ট সন্তানের আবির্ভাব হলো দৃশ্যপটে। বেঞ্চের একপ্রান্তে আমি, আরেক প্রান্তে প্রকৃতির সন্তান, এক বালক। কারো মুখে কোনো কথা নেই, এটাকে ঠিক সঙ্গ দেয়া বলা যায় না বোধহয়।
আমার আর বালকের দূরত্ব কমতে থাকল একটু একটু করে। বালক আমার দিকে এগোচ্ছে। কৌতূহলে নিশ্চয়ই। আমি তাকালাম কয়েকবার। তাকাতেই বালক মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে কিছু না বোঝার ভান করছে। খেলা একরকমের। আমি মজাই পেলাম এই খেলায়। বালকের নিষ্পাপ চেহারায়, নিষ্পাপ চোখদুটোতে ভান ধরা পড়ে যাচ্ছে। বালকের এখনও সময় আসেনি প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে এক বা একাধিক চরিত্রে অভিনয় করার।
বালককে পেয়ে আমি আমার একাকিত্বের কথা আর একা মানুষের মনস্তত্ব বিশ্লেষণের কথা ভুলে গেলাম। নীরবতা ভাঙতে চেষ্টা করলাম। বললাম, বাবু, তোমার নাম…
নাম আর জানা হলো না আমার। বালক একছুটে চলে গেল একটু দূরের আরেক বেঞ্চের কাছে।
একই দিনের একই বিকেলে দ্বিতীয়বার কেউ আমাকে একা ফেলে রেখে চলে গেল এই একই পার্কে।
বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। ও আমার প্রায় সবসময়ের সঙ্গী, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আজকে এভাবে একা ফেলে যাবার অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া যায়। ও এখন খুব একটা আনন্দে আছে বলে মনে হয় না।
একটা ছোট ব্যাগ আছে আমার সাথে। তাতে একা মানুষের সম্ভাব্য শেষ আশ্রয় আছে একটা। একটা বই। সুনীল গাঙ্গুলির সেরা কবিতার সংকলন। এটাকেই এবার সঙ্গী করে নেবার চেষ্টা করলাম।
সুবিধা করা গেল না। বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ চোখের সামনে ভাবনাধারা বইতে লাগল, সুনীল দাদা এভাবে পার্কে হঠাৎ একা হয়ে গেলে কী করতেন? কবিতা পড়তেন? নাকি লিখতেন? নাকি প্রকৃতি আর মানুষ দেখতেন? নাকি পার্কে কাটানো সুন্দর কোনো বিকেলের সুখস্মৃতি হাতড়াতেন? স্মৃতি। সেও তো মানুষকে সঙ্গ দিতে পারে। আসলে মানুষ কি একা হয় কখনো? স্মৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন? একলা না থাকার অভিনয়? নাকি একলা হবারই অভিনয়? একাকিত্ব যদিও…
হঠাৎ ছোট্ট বালকের কন্ঠে ভাবনাধারায় ছেদ পড়ল। তাকিয়ে দেখতে পেলাম একটু দূরের বেঞ্চের বালকটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এলেমেলো চুল,ময়লা চেহারা । পরনে ছেঁড়া পোশাক। পোশাকই বলে দিচ্ছে বালকটির অসহায়ত্বের কথা। তবে সেই পোশাকটাই ছিপছিপে গড়ন আর শ্যামবর্ণের সাথে মানিয়ে গিয়ে একটা বিশেষত্ব এনে দিয়েছে। প্রকৃতি নদীতে জল কম দিলেও বাঁক দিয়েছে নান্দনিক প্রাচুর্যে।বালকের বয়স হয়তো ১০-১২ হবে।
আমি নিজেকে তৈরি করে নিয়ে কিছু বলার আগেই বালক বলল, স্যার ১০টা টাকা দিবেন? আমি দুদিন ধরে কিছুই খায়নি। কথাটা শুনে অবাক হলামনা,তাকে পাশের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালাম। তারপর আবারও ফিরে এলাম পার্কে,বালকটিকে সঙ্গে নিয়ে।
বালক আর আমি দুজনেই নিরব।নিরবতা ভেঙে আমি তাকে বসতে বললাম,কিন্তু সে কিছুতেই আমার পাশে বসতে চাইনা, আমি জোর করে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার পাশে বসতে এত দ্বিধা কীসের?
বালকটির সোজাসাপ্টা উত্তর আমরা ছোট মানুষ, সবাই টোকাই বলে ডাকে,কেউ কখনো ভালবাসেনা,দেখলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়।
বালকটির উত্তর শুনে সভ্য সমাজের আমাদেরকেই ছোটলোক মনে হচ্ছে,মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল, আমরা এত হীন মনের কেন?আমরা কী পারিনা রাস্তার অসহায় মানুষদেরকে মানুষ বলে বিবেচনা করতে? নাকি আমরাই অমানুষ?
এতক্ষণ একটু অন্যমনস্ক হয়ে চিন্তা করছিলাম। এবার বালকটির দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতেই বালকটি বলল আসি স্যার।আমার প্রতিত্তোরের আশা না করেই বালকটি চলে গেল।
আমি শুধু নির্বাক চেয়ে আছি তার চলে যাওয়া পথের দিকে। ছেলেটার উপর একরকম মায়া পড়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিদিন ঐ পার্কে যেতাম, আর আমার চোখজোড়া তাকেই সন্ধান করত।কিন্তু কোনদিন দেখা মেলেনি। তবে তার মত অনেককেই দেখি এবং সাধ্যমত কিছু করার চেষ্টা করি।
এখন আমার মনে শুধু একটা প্রশ্নই গুরুপাক খায়,
কখনো কী আমরা প্রকৃত সভ্য হতে পারবনা?
রাস্তায় পড়ে থাকা হতদরিদ্র মানুষগুলোকে কী আমরা অবহেলায় করে যাব?
আবার পরক্ষণেই মন বলে উঠে, না না!
একদিন সকলেরই কর্মসংস্থান হবে! সুখের সংসার হবে,
কোন মা-বাবা তার সন্তানকে রাস্তায় ছেড়ে দেবেনা,
কোন শিশুকে আর শিশুশ্রম করতে হবেনা, সব শিশুরাই তাদের মৌলিক অধিকার পাবে।
একাকিত্ব অবশ্যই মনোবল কমিয়ে দেয়।
ReplyDelete